ষষ্ঠ বর্ষ, প্রথম় সংখ্যা
বাঙালি উৎসবপ্রিয়। তার পুস্তকপ্রীতির কথাও কারো অজানা নয়। তাই বাঙালির উৎসব উপলক্ষ্যেও বই দরকার। সেই সূত্রে বারোমাসে তেরো পার্বণের সেরা পার্বণ শারদীয়া দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে যে বই-পত্রিকা প্রকাশিত হয় তার কথা তুলে ধরা হল ‘হরপ্পা লিখন চিত্রণ’-এই সংখ্যায় ‘বুক-হিস্ট্রি’র বাংলাকেন্দ্রিক ইতিহাসের অংশ রূপে। ...
উৎসব মানেই আমুদে বাঙালির সব কিছুকে ছাপিয়ে যাওয়ার একটা দারুণ চেষ্টা। দুর্গাপুজো হলে তো আর কোনো কথাই নেই। সেই বাংলার উৎসবকে কেন্দ্র করে উনিশ শতকি একটি সংযোজন হল পুজো উপলক্ষ্যে বই-পত্রিকা মুদ্রণ। ১২৮০ বঙ্গাব্দের ১০ আশ্বিন কেশবচন্দ্র সেনের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সুলভ সমাচার’ এক পয়সা দামের ‘ছুটির সুলভ’ প্রকাশ করে ঠিক পুজোর আগেই। পৌত্তলিকতার বিরোধী ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্রের আদর্শে পরিচালিত সে পত্রিকায় পুজোসংখ্যা বা পুজোর কোনো উল্লেখ থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। বরং ‘আগামী ছুটি উপলক্ষে [...] উত্তম কাগচ, উত্তম ছাপা [...] এক পয়সা’ দামের কাগজটির কথা বলা হয়েছিস। এই ‘ছুটি’ যে দুর্গাপুজোর জন্যই ছিল, তা বলাই বাহুল্য। আবেদন করা হয়েছিল, সক্কলে যেন কেনে—শুধু কেনাই নয়, বলা হয়েছিল, ‘মজা করে পড়িতে পড়িতে ঘরে যাও’।
এমন সরাসরি পুজোর ছুটিকে কেন্দ্র করে পত্রিকা উনিশ শতকে কতগুলো বেরিয়েছিল, তা এই পুজোর আগে গুনতে বসা বড্ড ভারী কাজ। তবে বেশ কিছু রং তামাশার পাতলা চটি বই বটতলা বইবাজারে তখন পাওয়া যেত। সস্তাদামের বইগুলিতে লেখা শুরু হয়ে যেত মলাট থেকেই। ‘শ্রীশরচ্চন্দ্র দেব কর্ত্তৃক বিরচিত’ ১৮৯৫-এ ‘শ্রীরাজেন্দ্রলাল দাস কর্ত্তৃক প্রকাশিত’ ‘দুর্গাপূজার রং তামাসা।/পড় দিয়ে একটী পয়সা।।’ শীর্ষক বইটিতে মলাট থেকেই শুরু কাব্য—“এবার পূজায় গিরিবালা।/চেয়েছেন সোণার মোহনমালা।।/দুর্গাপূজার ভারি ধূম।/ভেবে লোকের নাইকো ঘুম।।”
আরেকটি এক আনা দামের বইয়ের মলাটে লেখা হয়েছিল— “এবার/গণেশের হয়েছে জ্বরবিকার।/পূজায় দুর্গার আসা ভার।।/পেট জুড়ে হয়েছে পিলে।/ডাক্তারে দিয়েছে এলে।।” আর তাই “চোখের জলে ভাসছে দুকূল।/কলা বউ কেঁদে আকুল।।”
পড়েই বোঝা যাচ্ছে, দেব-মাহাত্ম্য প্রচার এসব বইয়ের লক্ষ্য ছিল না। আমোদ-আনন্দটাই ছিল এগুলির কেন্দ্রীয় চরিত্র। থাকত কেচ্ছাও। যেমন শ্রীযুত বাবু হোঁৎকারাম বিরচিত এক আনা দামের বইটিতে ছিল, “ছোট বউ প্রাণপ্রিয়াসী। শাড়ী চেয়েছে বারাণসী।/পূজায় বেঁধেছে বিষম দাঙ্গা।/দুই সতিনের রক্ত-গঙ্গা।/দুই বিয়ের কেমন মজা।/আজ বাদে কাল দুর্গা পূজা।।”
বইগুলো কারা ছাপতেন বা লেখকদের সঠিক পরিচয় খুব পরিষ্কারভাবে জানা যায় না। তবে এদের মলাটের বিন্যাস মোটামুটি একইরকম। ওপরে ক’টা পংক্তি, নীচে লেখকের নাম, দাম ইত্যাদি, মাঝখানে একখানা কাঠখোদাই ছবি। ছবির দু-দিকে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে একটি করে লাইন লেখা। এহেন মজার পুজোর বই দেখে বোঝা যায়, এগুলির দারুণ লোকপ্রিয়তা ছিল। তবে এই সময় রং-তামাসার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় শারদীয় সাহিত্য বইটিতে তুলে ধরে ছিলেন এক কঠিন বাস্তব।
বিশ শতকের শুরুতে নামকরা সাময়িকপত্রগুলি পুজোর আগে বা পরের মাসের সংখ্যা আকারে কলেবরে বাড়িয়ে ছাপতে শুরু করে জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের রচনা। ১৩২০ সালের ‘ভারতবর্ষ’-এর কার্তিক সংখ্যা তার উদাহরণ। ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ‘বঙ্গবাণী’-র এমনই একটি সংখ্যায় শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ বা ১৩৩২ সালের বার্ষিক ‘বসুমতী’-তে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘পরিত্রাণ’। চিত্তরঞ্জন দাশ সম্পাদিত ‘নারায়ণ’ পত্রিকায় ১৩২২ সালে সরাসরি ঘোষিত হয় ‘সচিত্র শারদীয় সংখ্যা নারায়ণ’।
এরই মধ্যে বিদেশ থেকে ফিরে ১৩২৫ ও ১৩২৭ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রকাশ করেন ছোটোদের জন্য একটি বার্ষিকী—‘পার্ব্বণী’। বাংলাদেশের নামি কবি-লেখক-শিল্পীরা লিখেছিলেন-এঁকেছিলেন তাতে। ১৩২৭-এর পর ‘পার্ব্বণী’ আর না-বেরলেও ‘শিশুসাথী’, দেবসাহিত্য কুটিরের বার্ষিকী ও অন্যান্য বহু বার্ষিকপত্র প্রকাশিত হতে থাকে বছরের পর বছর ধরে। বার্ষিকীগুলির জনপ্রিয়তা দেখে অনেক সাময়িক ও দৈনিক পত্র প্রকাশ করে তাদের পুজোর বই। এভাবেই ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘যুগান্তর’, ‘বসুমতী’, ‘দেশ’ প্রভৃতি শারদসাহিত্যের ডালি সাজিয়ে পৌঁছে যায় বাঙালির ঘরে ঘরে। এগুলির অনেক ক’টিতেই শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লেখা থাকত না, থাকত ছোটোদের পাতাও।
যুগেকালে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এই বার্ষিকী ও শারদীয়ার সংখ্যা। এখনও সাহিত্যপত্র তো বটেই, সংবাদপত্র, নাটকের কাগজ, সিনেমার সাময়িকী, খেলার পত্রিকা, কল্পবিজ্ঞানের ম্যাগাজিন, রাজনৈতিক দলের মুখপত্র, ই-পত্রিকা, এমনকি লিটিল ম্যাগাজিনও প্রকাশ করে শারদ পত্রিকা। ‘হরপ্পা লিখন চিত্রণ’-এর বর্তমান সংখ্যাটিও তার ব্যতিক্রম নয়। বারোয়ারি পুজোগুলোতেও পুজো উপলক্ষ্যে বিজ্ঞাপন ছেপে অর্থসংগ্রহের জন্য মুদ্রিত হয় স্মরণিকা। তাতেও সাহিত্যের ছোঁয়া থাকে কখনো কখনো।
বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠা শারদপত্রিকা ছাপার দুই ভগীরথ বিদেশফেরত কেশবচন্দ্র ও নগেন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে বিদেশে বড়োদিন উপলক্ষ্যে প্রকাশিত উৎসব সংখ্যাগুলি দেখে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তবে তাঁরা কোনোভাবেই অন্ধ অনুকরণ করেননি, বরং তাঁদের প্রয়াসগুলি বা পরবর্তী সময়ের প্রকাশনাগুলি ছিল সম্পূর্ণ নিজস্বতায় গড়ে ওঠা বাংলার শ্রেষ্ঠ উৎসব উপলক্ষ্যে প্রকাশিত বাংলা ভাষার অন্যতম সেরা সাহিত্যসম্ভার। সর্বোপরি তার সুর ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার তারে বাঁধা। সে চেতনা আজও প্রবাহিত হচ্ছে পুজোর বইয়ের পাতায় পাতায়। আশা করব একই সুর বাজবে যতদিন বাংলাভাষায় প্রকাশিত হবে এই উৎসবের বই। কারণ উৎসব আমোদের, আনন্দের। উৎসব সবার।
প্রকাশকাল: অক্টোবর ২০২২
প্রচ্ছদ ও শিল্প-নির্দেশনা: সোমনাথ ঘোষ
সম্পাদক: সৈকত মুখার্জি
ছবি
• দেবব্রত ঘোষ
‘ছুটির সুলভ’: প্রথম বাংলা শারদপত্র
• সর্বজিৎ মিত্র
বিলুপ্ত সাময়িকপত্রে দুর্গা ও দুর্গোৎসব • নবকুমার ভট্টাচার্য
মাসিক থেকে বার্ষিকী: ‘শিশুসাথী’র বয়ঃপ্রাপ্তি
• অমিতাভ সেনগুপ্ত
‘পার্ব্বণী’ এবং রবীন্দ্রনাথ-নগেন্দ্রনাথ সম্পর্ক
• অভীককুমার দে
ছোটোদের পূজাবার্ষিকী : পুজোর নতুন উপহার
• বর্ণালী পাল
দেব সাহিত্য কুটীরের বার্ষিকী
• রূপা মজুমদার
... পুজোর দেব সাহিত্য কুটীর: ছবি, শৈলী ও অন্যান্য
• অরণ্য সেনগুপ্ত
ক্ষণজীবী কিশোরপাঠ্য বাংলা পূজাবার্ষিকী
• দেবাশিস গুপ্ত
‘প্রবর্ত্তক’-এর শারদসংখ্যা
• উৎপল চক্রবর্তী
বেতারের আলোর বেণু ও মুদ্রিত মহিষাসুরমর্দিনী
• অভীক চট্টোপাধ্যায়
পুজোর বাজারে ‘বেতার জগৎ’
• ভবেশ দাশ
পুজোর ছুটি ও রেলগাড়ির গল্প
• সত্যশ্রী উকিল
শারদ প্রাতের সফরনামা
• ভাস্কর দাস
পরিযায়ী পরিক্রমা
• অনির্বাণ গাঙ্গুলি
বরাক উপত্যকার শারদসংখ্যা
• আশিসরঞ্জন নাথ
ত্রিপুরায় প্রকাশিত বাংলা শারদপত্রিকা
• সুস্মিতা দেবনাথ
পুজোসংখ্যার ছায়ানট শারদসংখ্যার দরবারি
• কিন্নর রায়
‘পূজাবার্ষিকী’ ও ‘শারদীয়’ পত্রিকায় বঙ্গতনয়া
• অঙ্কন ঘোড়ই
শারদসংখ্যায় রুপোলি ছোঁয়া
• স্পন্দন ভট্টাচার্য
শারদীয় যৌনপত্রিকায় দেহ ও গার্হস্থ্য ভাবনা
• বিজলীরাজ পাত্র
পুজোর ছবি, কাশফুল অথবা ছাইভস্ম
• সন্দীপ দাশগুপ্ত
শারদীয়া পত্রিকার প্রচ্ছদে দুর্গা
• প্রদীপ দত্ত
আমার পুজোর বই
• পার্থ দাশগুপ্ত
পূজাবার্ষিকীর বিজ্ঞাপন ও ‘সামাজিক কৃত্য’র নির্মাণ
• আত্মজিৎ মুখোপাধ্যায়
লিটিল ম্যাগাজিনের পূজাবার্ষিকী • সন্দীপ দত্ত ছোটোদের ভাবাতে চেয়েছিল ‘কিশোর’
• ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী
কল্পবিজ্ঞানের শারদোৎসব
• দীপ ঘোষ ও সন্তু বাগ
খেলার পূজাবার্ষিকীর সংক্ষিপ্ত জীবন
• প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত
বারোয়ারি দুর্গাপুজোর মুদ্রিত স্মরণিকা
• সৈকত মুখোপাধ্যায়
গ্রাহক হোন
হরপ্পার গ্রাহক হতে গেলে দুটি সংখ্যার জন্য মোট সাতশো টাকা দিতে হয়। (অতিরিক্ত ডাকমাশুল লাগবে না)
যোগাযোগ করুন ই-মেলে অথবা ফোনে কথা বলুন।
সরাসরি প্রাপ্তিস্থান
• হরপ্পার পরিবেশক পশ্চিমবঙ্গে অক্ষর প্রকাশনী, ১৮এ টেমার লেন, কলকাতা-৯ ও বাংলাদেশে বাতিঘর।
• কলেজস্ট্রিটে পাতিরাম, ধ্যানবিন্দু, দেজ, দে বুকস্টোর, উল্টোডাঙায় সুনীলদার দোকান, রাসবিহারী মোড়ে কল্যাণদার দোকান, রিড বেঙ্গলি বুক স্টোর, শান্তিনিকেতনে রামকৃষ্ণর দোকানের মতো বহু স্টলে হরপ্পা নিয়মিত পাওয়া যায়। এছাড়া অনলাইনে হরপ্পা বিক্রি হয়।
• পত্রিকা পেতে আপনি দপ্তরেও মেল করতে পারেন।
বৈদ্যুতিন পুস্তিকা
করোনার আক্রমণে অন্তরীণ অবস্থায় ১ বৈশাখ ১৪২৭ থেকে ‘হরপ্পা’-র বৈদ্যুতিন পুস্তিকা প্রকাশের সূচনা। এই পুস্তিকা নিজেদের ওয়েবসাইট, সামাজিক মাধ্যম, যেমন ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে পাঠকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। দেখবেন চলুন...