সপ্তম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা
অনেকেরই শেখার শুরু ঠাকুমা-দিদিমা, মা-মাসি-পিসিদের মুখে বলা ছড়া, গল্প শুনে শুনে। কিন্তু ছেলে-ভোলানো ছড়া বলা, ঘুম-পাড়ানো গান গাওয়ার পাশাপাশি বাঙালি মহিলারা লেখালিখিও শুরু করেছিলেন বহু আগে। এ সংখ্যায় সেসব সাহিত্যকৃতির পর্যবেক্ষণ রয়েছে বিভিন্ন বয়সি নারীর কলমে। সঙ্গে পুস্তিকাকারে পুনর্মুদ্রিত হল মুহম্মদ এনামুল হক-এর ‘মধ্যযুগীয় বাংলা-সাহিত্যের মুসলিম মহিলা কবি’ প্রবন্ধটি। ...
জন্মের পর আমরা প্রথাগতভাবে পড়তে লিখতে শেখার আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় আমাদের পাঠ, সে-পাঠ প্রকৃতিপাঠ—প্রকৃতিকে দেখে শেখা, প্রকৃতিতে থেকে শেখা। সে-শেখা শুরু হওয়ারও আগে, শুনে শুনে আমাদের আরেক ধরনের শিক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছিল। মা-মাসি, পিসি-জেঠি, ঠাকমা-দিদিমার কোলে ঘুরতে ঘুরতে নানারকম আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজার গল্প শুনতে শুনতে শেখা। আমারও ঠিক তেমনভাবেই শেখার শুরু। ইটের জঙ্গলে নানা বিধি-নিষেধের মধ্যে বড়ো হওয়ার সময় রামায়ণ থেকে মহাভারত, পুরাণ থেকে পরনকথা, প্রাচীন থেকে আধুনিক গল্পগাছা মনের ভিতর শিকড় ছড়িয়ে দিয়েছিল খাওয়া কিংবা ঘুমানোর সময় গল্প শুনে শুনেই। সুরের মতো সেই শ্রুতির রেশ রয়ে গেছে বহুদিন। ঠিক যেমনটা রয়ে গেছে ঘুম থেকে ওঠার সময় দাদির মুখে (আমি আজীবন ঠাকুমাকে দাদি বলতাম, কেন বলতাম মনে নেই, মনে করিয়ে দেওয়ার লোকগুলোও আজ আর নেই, আর সে প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ারও কোনো মানে হয় না) শোনা ছড়াগুলো, যেমন—
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?
মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন
‘মানুষ হইতে হবে’—এই যার পণ৷
প্রথমে ভাবতাম দাদি নিজেই বুঝি মুখে মুখে ছড়াগুলো বানিয়েছে। পরে আরেকটু জানতে-বুঝতে শিখে শুনলাম ওটা কুসুমকুমারী দাশের লেখা। না, কুসুমকুমারীর স্বনামধন্য পুত্র জীবনানন্দের নাম তখনো পর্যন্ত শুনিনি। সবে তখন সহজপাঠ শেষ হয়েছে, শুরু হয়েছে কিশলয়। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল,সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, নজরুলের পাশাপাশি মনে গেড়ে বসেছেন কামিনী রায়ও—
পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মতো সুখ কোথাও কি আছে
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
কী করে ভুলব—নানা ধরনের গল্পের বই সদরে অন্দরে পড়ার ফাঁকে ততদিনে পড়ে ফেলেছি পদি পিসির বর্মী বাক্স আর মনে স্থায়ী আসন পেতেছি সে-কাহিনির লেখক লীলা মজুমদারের জন্য। ওঁর লেখা পড়েই তো হাতির স্মৃতিশক্তির কথা জেনেছিলাম।
আমার মতো অনেকেরই শেখার শুরু মুখে মুখে বলা এরকম ছড়া শুনে। সেগুলির রচয়িতা সম্ভবত মেয়েরাই। কিন্তু কোনো ভণিতা না-থাকায় সেগুলো কে লিখেছিলেন সে-সূঁচ খড়ের গাদায় খোঁজার চেষ্টা আজ বৃথা। তবে বাঙালি মেয়েদের লেখালিখির শুরুর কথা বলতে গিয়ে অনেকেই মধ্যযুগের কবি চন্দ্রাবতীর নাম বলেছেন। তাঁর একটি পরিচয় পাওয়া গেলেও তাঁর কর্মকাল ও কর্মকালের ব্যাপ্তির নিশ্চিত সময়সীমা কেউ এখনো বলতে পারেননি। যা আলোচিত হয় তা আনুমানিক। এ সত্ত্বেও নিত্যানন্দের পত্নী জাহ্নবা দেবী বা যাদবেন্দ্র দাসের পত্নী স্বর্ণলালীর নাম একই সঙ্গে উচ্চারিত হলেও মৌলিক চিন্তাধারায় রামায়ণ রচনার জন্য দ্বিজ বংশীদাস কন্যা চন্দ্রাবতী অনেক বেশি আদরণীয়। আকারে খুবই ছোটো এই রামায়ণ-এ তিনটি কাণ্ড—সুন্দরকাণ্ড, যুদ্ধকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ড—৩০৭টি সর্গে ১৯টি অধ্যায়ে সাজানো। আকারে ছোটো হলেও তাঁর রামায়ণ-এর গুরুত্ব এর কাহিনির মৌলিকতায়। সে-কথা পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড)-য় (পৃ ৫২৩) দীনেশচন্দ্র সেনও স্বীকার করেছেন, “আশ্চর্য্যের বিষয় চন্দ্রাবতীর রামায়ণে বাল্মীকি বা কৃত্তিবাসের বৃত্তান্তের অনুরূপ কাহিনী আমরা পাই না। তিব্বত, মালয়, কাশ্মীর, জাভা প্রভৃতি স্থানে সীতার জন্ম সম্বন্ধে যে সব প্রবাদ আছে, চন্দ্রাবতী সেই সকল কথাই আমাদিগকে শুনাইয়াছেন।”
চন্দ্রাবতীর মতো মধ্যযুগীয় আর কোন কোন নারী গোপনে কী কী মণিমুক্তো ছড়িয়ে ছিলেন তা অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। অনেক সময় মেয়েরা বা মায়েরা লিখেছেন বলা হলেও তার প্রামাণিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন বহুজন। কিন্তু এর বেশ কিছুই বাঙালি মেয়েদের লেখা। সেসব লেখায় শুধু ঘরগেরস্থালির কথা নয়, পাঁচালি বা ছেলেভুলোনো ছড়া নয়, আছে সমাজ বা ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিবরণ। এসব লেখা যে মেয়েদের তার প্রমাণ আছে বলে অনুরূপা দেবী তাঁর সাহিত্যে নারী: স্রষ্ট্রী ও সৃষ্টি-তে (পৃ ১০৯) উল্লেখ করেছেন, যেমন তিনি উদাহরণ হিসেবে “একটি উত্তরবঙ্গের ছড়ায় নারী কবি মির্জাপুর ও রহিমনগরের দাঙ্গার বিবরণ" দিয়েছেন —
খবরিয়া খবর কয়, ছমির চকিদার।
তোমার দুই পুত মারা যায়, ভরসা কর কার?
শুইনা বেকরার হুঁস হইয়া বান্ধিল কমর।
ডাইন হাতে লইল লাঠি, বাঁও হাতে ফল।
মার মার কইরা ছমির গোঁস্বায় জ্বলিল।
আল্লা নবীর নাম কিছু স্মরণ না করিল॥ […]
সেসব ছড়া-কবিতা-পাঁচালি সময়ের স্রোতে আমাদের কাছে এসে পৌঁছনোর সময় হারিয়েছে তাদের আদি রূপ—বিশুদ্ধতার ছোঁয়ায় তাকে শুদ্ধ করতে গিয়ে লুপ্ত হয়েছে ইতিহাসের গন্ধ। সতীনের খোয়ার, শাশুড়ি ননদের ঝগড়া বা বউদের দোষত্রুটি নিয়ে লেখা ছড়া আর গোলকায়নের যুগে কোথায় শোনা যায়।
আঠেরো শতকের বিক্রমপুরের জপসা গ্রামের আনন্দময়ীর কাব্যের ভারতচন্দ্রের যুগধর্মিতা, বা তাঁর বোন গঙ্গা কিংবা দয়ার রচিত পদে ভাষার সারল্য না-থাকলেও সুর ছিল। তবে এই বিকাশ ঘটেছিল নারীদের শিক্ষার এক চোরাস্রোত বাংলায় বৈষ্ণব অভ্যুত্থানের ফলে তৈরি হওয়ায়। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বর্ধমানের কলাইঝুটি গ্রামের নারায়ণ দাসের কন্যা রূপমঞ্জরী। ব্যাকরণ-কাব্য-বৈদ্যশাস্ত্রে দক্ষ রূপমঞ্জরী শুধু শেখেনইনি—শিখিয়েওছেন।
শেখা ও শেখানোর এই ধারা সে-যুগের বৈষ্ণবীদের মধ্যে ভালোভাবেই ছিল। তাঁরা নিজেরা যেমন শিখতেন, তেমন বাড়ি বাড়ি ঘুরে সে-বিদ্যা দান করে বেড়াতেন। মূলত হরিনাম সংকীর্তন করতেন বলে বাড়ির অন্দরমহলে তাঁদের ছিল অবাধ গতি। উদ্যোগ নিয়ে তাঁরাই মেয়েদের লেখাপড়া শিখলে অমঙ্গল হয় এই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়ে শিক্ষার আলো নিজেরা দেখার পাশাপাশি অন্যের ঘরে তাই পৌঁছে দিয়েছিলেন। এমনই বৈষ্ণবীদের যাতায়াতের কথা শোনা যায় শোভাবাজারের দেববাড়িতে বা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির মতো অভিজাত গৃহীর অন্দরমহলে। বিদুষী বৈষ্ণবী শ্যামাসুন্দরী, হটি বিদ্যালংকার প্রমুখের কথা আমরা যেমন পাই রাধাকান্ত দেবের লেখায় তেমনই রেভারেন্ড লং বাংলা বইয়ের তালিকা করতে গিয়ে ফরিদপুরের সুন্দরী দেবীর উল্লেখ
করেছেন।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে শ্রীহট্টের হরিভক্তি তরঙ্গিণী-র রচয়িতা সহজিয়া সাধক শ্যামকিশোর ঘোষের সাধনসঙ্গিনী শ্রীমতী যে আধ্যাত্মিক পদ রচনা করেছিলেন, তা রঘুনাথ লীলামৃত-য় উদ্ধৃত হয়েছে। এছাড়াও নামহীন প্রকাশিত হয়েছে বহু বাঙালি মেয়েদের লেখালিখি। কিন্তু উনিশ শতকের মাঝামাঝি স্ত্রীশিক্ষার প্রসার, ইংরিজি শিক্ষার প্রভাব, ব্রাহ্মধর্মের বিস্তার ও বাংলা মুদ্রণ বিস্ফোরণের পর বাঙালি মেয়েদের সাহিত্যক্ষেত্রে বিচরণ আরো নির্দিষ্টভাবে চোখে পড়তে লাগল। লোকলজ্জার ভয়ে নামগোপন করে লেখার দিন তাঁদের বোধহয় এসময়ে
শেষ হল।
ঈশ্বর গুপ্ত সম্পাদিত ‘সংবাদ-প্রভাকর’-এ ছাপা হয়েছিল বাঙালি মেয়েদের কবিতা। সে-প্রসঙ্গে স্বয়ং গুপ্ত-কবি ‘প্রভাকর’-এ ২২ পৌষ ১২৬৪ (৫ জানুয়ারি ১৮৫৮) লিখেছেন, “একটী ভদ্র কুলাঙ্গনা বিরচিত পতি-বিরহ বিষয়ক কবিতা আমরা অত্যন্ত আদর ও যত্নপূর্ব্বক প্রকটন করিতেছি, পাঠক মহাশয়েরা মনোযোগ পূর্ব্বক পাঠ করিলে সাতিশয় সন্তোষ সঞ্চয় করিবেন। আমরা অনেক অনুসন্ধান করিয়া এবং কতিপয় প্রামাণ্য লোকের প্রমুখাৎ বিশেষরূপে শ্রবণ করিয়া অবগত হইলাম, ঐ রচনাটী যথার্থই * * কামিনীর বিরচিত। স্ত্রীলোক হইতে এতদ্রূপ সর্ব্বাঙ্গসুন্দর উৎকৃষ্ট পদ্য প্ররচিত হইয়াছে; ইহা আমরা পূর্ব্বে বিশ্বাস করি নাই, এ কারণ বহুদিবস পর্যন্ত অপ্রকাশ রাখিয়াছিলাম, ইহাতে উক্তা রচনাকারিণী নিতান্তই দুঃখিনী হইয়া দ্বিতীয় একটা কবিতা পুনর্ব্বার প্রেরণ করেন। আমরা তাহাতে সন্দিগ্ধ হইয়া এ পর্য্যন্ত তৎপ্রকাশ পরাঙ্মুখ ছিলাম, কিন্তু এইক্ষণে বিশ্বাসী বন্ধুর বচনে বিশ্বাস জন্মিবার সন্দেহশূন্য হইয়া একটী শব্দও পরিবর্ত্তন না করিয়া অবিকল পত্রস্থ করিলাম। কবিতায় যে সকল বিষয়ের আবশ্যক করে, ঐ রচনায় তাহাই আছে; কোনো অংশেই কিছু মাত্র বৈলক্ষণ্য হয় নাই, * * * ... ...
হে স্ত্রী-বিদ্যার বন্ধুগণ! আপনারা এই পদ্যটী একবার পাঠ করুন।”—“বহুগুণালঙ্কৃত মান্যবর শ্রীযুক্ত প্রভাকর সম্পাদক মহাশয় বহুগুণ-মন্দিরেষু।
এ অধীনী কর্ত্তৃক পয়ার ছন্দে বিরচিত নিম্নলিখিত কতিপয় পংক্তি সংশোধনানন্তর প্রকাশ করিয়া উৎসাহ বর্দ্ধনে আজ্ঞা হইবেক।
পয়ার।
আশাপথ নিরখিয়ে আছয়ে কামিনী।
যেমন চকোরী থাকে, আগতে যামিনী॥
সেইরূপ কিছুদিন করিলাম ক্ষয়।
তবু সেই প্রাণকান্ত না হলো উদয়॥
[থানা রাজাপুরের অন্তঃপাতি ইলিপুর নিবাসিনী কুলকামিনী শ্রীমতী অনঙ্গমোহিনী দাসী] ২৯শে কার্তিক। ১২৬৪।”
উনিশ শতকের সংবাদপত্র ও প্রকাশনার অন্যতম শক্তিশালী এক ব্যক্তিত্বের লিখিত জবানবন্দি থেকে একথা স্পষ্ট যে তখনো মেয়েদের নিজপরিচয়ে লেখা ছাপা ও তার গুণাগুণ নিয়ে একটা সন্দেহের বাতাবরণ ছিল— “স্ত্রীলোক হইতে এতদ্রূপ সর্ব্বাঙ্গসুন্দর উৎকৃষ্ট পদ্য প্ররচিত হইয়াছে; ইহা আমরা পূর্ব্বে বিশ্বাস করি নাই", এবং সন্দেহবশে তা দীর্ঘকাল ছাপাও হত না—“এ কারণ বহুদিবস পর্যন্ত অপ্রকাশ রাখিয়াছিলাম", তবে সন্দেহ নিরসনের পর তা অবিকৃত অবস্থায় যে ছাপা হয় তাও তিনি ঘোষণা করেন—“বিশ্বাস জন্মিবার সন্দেহশূন্য হইয়া একটী শব্দও পরিবর্ত্তন না করিয়া অবিকল পত্রস্থ করিলাম"।
মেয়েদের লেখা পাঠানো, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ ও তদন্ত এবং পরিশেষে তা নিরসন ও মুদ্রণ—এই জটিল প্রক্রিয়াজাল অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। স্বর্ণকুমারীর মতো বহু বাঙালি মেয়েই এগিয়ে এসেছিল পত্রিকা সম্পাদনায়। এছাড়া যাঁদের বই মুদ্রিত হয়েছিল তাঁদের মধ্যে কৈলাসবাসিনী দেবীর হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা (১৮৬৩), অজ্ঞাতনাম্নী লেখিকার কবিতামালা (১৮৬৫), কোন্নগর বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রী, মার্থা সৌদামিনী সিংহের নারীচরিত (১৮৬৬), প্রথম গার্হস্থ্য উপন্যাস হেমাঙ্গিনী দেবীর মনোরমা (১৮৬৬-তে লেখা হলেও ছাপা হয় ১৮৭৪-এ), ১২৭৫ সালে প্রকাশিত রাসসুন্দরী দেবীর আত্মজীবনী আমার জীবন, কৈলাসবাসিনী দেবীর কবিতার বই বিশ্বশোভা, কামিনীসুন্দরী দেবীর নাটক উর্ব্বশী (১৮৬৯) এবং দয়াময়ী দেবীর পতিব্রতা ধর্ম (১৮৬৯), অন্নদাসুন্দরী দেবীর কবিতার বই অবলাবিলাপ (১৮৭২), লক্ষ্মীমণি দেবীর গার্হস্থ্য বিষয়ক নাটক চিরসন্ন্যাসিনী (১৮৭২) নিতম্বিনী দেবীর নাটক অনূঢ়া যুবতী (১৮৭২), হরকুমার ঠাকুরের সহধর্মিণী রচিত গার্হস্থ্য উপন্যাস তারাবতী (১৮৭৩) এবং ইন্দুমতী দাসী প্রণীত কবিতার বই দুঃখমালা (১৮৭৪) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই সময়েই তাহেরুন্নিছা বিবি, রমাসুন্দরী ঘোষ, ক্ষীরোদা দাসী, শৈলজাকুমারী দেব্যা, মধুমতী গঙ্গোপাধ্যায়, বিন্ধ্যবাসিনী দেবী, কামিনী দত্ত, রাধারাণী লাহিড়ী, ভুবনমোহিনী দেবী, কুন্দমালা দেবী, নীরদা দেবী, সৌদামিনী খাস্তগীর প্রমুখ বহু বাঙালি নারীর সাহিত্যচর্চার কথা জানা যায়।
উনিশ শতক থেকে বিশ শতকে এই সাহিত্যচর্চার হার অনেক গুণ বৃদ্ধি পায়। ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা উনিশ শতক থেকেই সাহিত্যের নানা অংশে যে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন তা উত্তরোত্তর আরো সমৃদ্ধ হয়। তাঁদের দেখাদেখি অন্যান্য ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়েরাও সাহিত্য রচনা ও তার প্রসারে বিশেষ উদ্যোগী হন। ‘কুন্তলীন’ পুরস্কারের মতো সাহিত্যের প্রতিযোগিতাতে তাঁরা অংশ নেন ও পুরস্কার জিতে নেন। আগের শতকের শেষ থেকেই প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী ‘পুণ্য’ পত্রিকা প্রকাশ করে লিখতে শুরু করেছেন রান্না বিষয়ে। বেগম রোকেয়া এগিয়ে এসেছেন তাঁর সৃষ্টি নিয়ে সাহিত্যের দরবারে। সাহিত্যের জনপ্রিয় শাখা গোয়েন্দা-কাহিনিও লিখতে শুরু করেছেন বনলতা দেবী, মৃন্ময়ী দেবী, রুবি মল্লিক, সরোজকুমারী ব্যানার্জি, সুষমা সেন প্রমুখ আরো অনেকে। অবলা বসু, রাণী চন্দ, রাধারাণী দেবী প্রমুখ বাঙালি মেয়েদের সচিত্র ভ্রমণ-কাহিনি ছাপা হতে শুরু করেছে পত্রপত্রিকার পাতায়।
সময় যত এগিয়েছে তত জটিল হয়েছে জীবন, কিন্তু বেড়েছে সাহিত্যচর্চার সুযোগ ও ধারা। বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে শেষভাগ অবধি সে-সুযোগ বেড়েছে বই কমেনি। কবিতা, নাটক, গল্প, উপন্যাসে জীবনের জটিলতা অনায়াসে জায়গা করে নিয়েছে। অনেক বেশি স্বাধীনতা পেয়েছেন লেখকরা সে-ছবি তুলে ধরতে। একুশ শতকে সমাজমাধ্যম ও বৈদ্যুতিন দুনিয়ায় সুযোগ আরো অনেক গুণ বেড়েছে। কোনো কিছু প্রকাশ করতে আর কারো ইচ্ছাধীন হওয়ার প্রয়োজন নেই তাঁর। প্রয়োজন নেই কাগজ, কলম, ডিটিপি, কম্পিউটরের। হাতে-ধরা মুঠোফোনে অনায়াসে লেখা হয়ে যাচ্ছে বক্তব্য, বিশ্লেষণ, কবিতা, নাটক, গল্প। মুহূর্তেই জুড়ে দেওয়া যাচ্ছে ছবি। আর তা নিমেষেই তুলে ধরা যাচ্ছে সবার সামনে আন্তর্জালের সূত্রে। বাঙালি মেয়েরা এর কোনো ক্ষেত্রেই পিছিয়ে নেই। তাঁরা আজ বৈশ্বিক নাগরিক। তাঁদেরও মুঠোর মধ্যেও ধরা রয়েছে দেশদুনিয়ার তত্ত্বতালাশ। তাই তাঁরা শুধু সাহিত্যচর্চাই করছেন না, তা সময় ও স্থানের গণ্ডি ভেঙে পৌঁছে দিচ্ছেন পৃথিবীর নানা কোণে বাঙালি পাঠকের দরবারে। শুধু বাংলায় নয়, বাঙালি মেয়েরা তরু দত্ত-সরোজিনী নাইডুর মতো ইংরিজি ভাষায় সাহিত্যচর্চায়ও আজ অগ্রণী।
বাংলা ‘বুকহিস্ট্রি’র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘বাঙালি মহিলাদের লেখালিখি’ শীর্ষক ‘হরপ্পা লিখন চিত্রণ’-এর বর্তমান সংখ্যায় এই দীর্ঘ ইতিহাসকে একত্রিত করার একটা কষ্টপ্রয়াস করা হয়েছে। একটি সংখ্যায় এ ইতিহাস ধরার প্রচেষ্টা অসম্ভব। তবুও স্বল্প সময় পরিসরে একটা রূপরেখা দেওয়ার চেষ্টা করা হল। ষোড়শ শতাব্দীতে বাঙালি বৈষ্ণবী রচিত পুথির চর্চার পাশাপাশি তুলে ধরা হল উনিশ শতকে প্রসারিত হওয়া মেয়েদের সাহিত্যচর্চার ইতিহাস কবিতা, নাটক, উপন্যাস, আত্মজীবনী প্রভৃতি নানা ধারায় কীভাবে বিস্তৃত হল। দেখানো হল, রান্নার বই কিংবা ভ্রমণ-সাহিত্যে কীভাবে সক্রিয় ছিল বাঙালি নারীর কলম। কেমন করেই-বা লেখনীর গুণে তাঁরা জায়গা করে নিয়েছিলেন গোয়েন্দকাহিনিপ্রেমী পাঠকদের মনে। আবার
বাঙালি মেয়েদের পত্রপত্রিকা সম্পাদনার সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের পাশাপাশি রয়েছে পত্রিকার বিজ্ঞাপন কিংবা এখনো চালু ও বর্তমানে বন্ধ হয়ে যাওয়া তিনটি পত্রিকা-সম্পাদকের সরাসরি অভিজ্ঞতার বর্ণনা। রয়েছে বাংলা লেখকদের প্রথম সংগঠন ‘সই’-এর প্রসঙ্গও। এসেছে শূন্য দশকের কবিদের কথাও। শুধু তাই নয় ইতিহাসের পাশাপাশি এসেছে গিরীন্দ্রমোহিনী থেকে হাল আমলের তৃপ্তি সান্ত্রা পর্যন্ত বেশ কজন লেখকের সাহিত্যকৃতি নিয়ে আলাদা আলাদা আলোচনা। এঁদের কেউ কবি, কেউ ঔপন্যাসিক, কেউ আত্মজীবনীর রচয়িতা, কেউ ছোটোগল্পকার, কেউ-বা প্রাবন্ধিক। তৃপ্তি সরাসরি কোনো আড়াল না-রেখে জানিয়েছেন আধুনিক ধারায় সাহিত্যচর্চা করতে গিয়ে এই সময়েও একজন নারীকে কী হেনস্থাই-না সহ্য করতে হয়। তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত এই অভিজ্ঞতা আমাদের জাগ্রত বিবেকে আঘাত করে।
এই সংখ্যায় দুটি পুনর্মুদ্রণসহ অন্যান্য লেখাগুলি এক বিরাট ক্ষেত্র ও সময়সীমাকে ধরলেও পর্যায়ক্রমিক ইতিহাসকে তুলে ধরায় ত্রুটি থেকে গেল। সে-ত্রুটি এ পরিসরে ধরা সম্ভব নয়। একাধিক প্রয়াসে সে খেদ মিটতে পারে।
এ সংখ্যাটিতে মূলত মেয়েদের কলমেই এই ইতিহাসকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। অনেকেই ভাবতে পারেন এটি তাঁদের প্রান্তিকীকরণের একটি প্রয়াস। এ ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক। ‘হরপ্পা’ করোনাকালে বৈদ্যুতিন পুস্তিকা প্রকাশের সময়েও লকডাউনে গৃহবন্দি নারীর অভিজ্ঞতা পিঞ্জরে বসিয়া-তে তুলে ধরেছিল। অক্টোবর ২০২০-তে প্রকাশিত ‘দুর্গতিনাশিনী’ শীর্ষক মুদ্রিত শারদসংখ্যায় (চতুর্থ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা) বানান ও অন্যান্য শুদ্ধীকরণ-সম্পাদনা ছাড়াই ‘মা’ শীর্ষক অংশে ছাপা হয়েছিল “তেরোজন বর্ষীয়সী নারীর পুজোর অভিজ্ঞতার সংকলন।
এঁদের কারোর জন্ম গত শতকের দুয়ের দশকে কারো ওই শতকেরই চারের দশকের শেষ পাদে। কেউ জন্মেছেন মেদিনীপুরে, কেউ-বা ফরিদপুরে, কেউ আবার মুর্শিদাবাদে। পেশাগত জীবনেও বৈচিত্র্য রয়েছে এঁদের। […]"। বর্তমান সংখ্যায়ও প্রায় নব্বই বছর বয়স্ক লেখকের অভিজ্ঞতার বয়ান থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ নবাগত লেখকের লেখা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে একটি বিশেষ প্রতীক হিসেবে। পুরুষেরা মেয়েদের সাহিত্যের আলোচনা ও মূল্যায়ন করেছেন বহুদিন আগে থেকেই। মনীষা-মঞ্জুষা (জুন ১৯৭১) গ্রন্থ থেকে পুনর্মুদ্রিত মুহম্মদ এনামুল হক-এর ‘মধ্যযুগীয় বাংলা-সাহিত্যের মুসলিম মহিলা কবি’ প্রবন্ধটি বর্তমান পত্রিকাটির সঙ্গে সম্পূর্ণ পৃথকভাবে পুস্তিকাকারে বিতরিত হল তারই একটি উদাহরণ স্বরূপ।
প্রকাশকাল: অক্টোবর ২০২৩
প্রচ্ছদ ও শিল্প-নির্দেশনা: সোমনাথ ঘোষ
সম্পাদক: সৈকত মুখার্জি
নারীশিক্ষার দেশজ ধারা ও হেমলতা ঠাকুরাণীর ‘মানবী বিলাস’
• অপর্ণা রায়
উনিশ শতকের বাঙালি মহিলা কবিদের কথা
• পিয়ালী রায়
অশ্রু-মানিক দিয়ে গাঁথা: কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর কাব্যভুবন
• নন্দিনী বন্দ্যোপাধ্যায় দে
রাসসুন্দরী দেবী: সময়ের প্রতিফলক
• যশোধরা রায়চৌধুরী
ইন্দো-অ্যাংলিয়ান কাব্যের দুই মহীয়সী
• সংযুক্তা দাশগুপ্ত
উনিশ শতকের নারীবিশ্ব: আত্মজীবনী-স্মৃতিকথার দর্পণে
• জয়িতা দাস
উনিশ থেকে বিশের শুরুতে মেয়েদের লেখা উপন্যাস: একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
• বৃহস্পতি বোধক
... বাঙালিনি নাটককার: প্রাক্ স্বাধীনতাপর্ব
• শম্পা ভট্টাচার্য
বাংলা রান্নার বই: স্রষ্টা যখন নারী
• অন্বেষা রিনি
বাঙালি নারীর ভ্রমণকাহিনি
• দময়ন্তী দাশগুপ্ত
বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্য: মেয়েদের কলম
• রণিতা চট্টোপাধ্যায়
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত মেয়েদের সম্পাদনায় বাংলা পত্রপত্রিকা
• মুন গায়েন
সাময়িকপত্র সম্পাদনে বাংলা থেকে বাংলাদেশে মুসলমান নারীর পথচলা
• ফেরদৌস আরা আলীম
সাহিত্যে রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন
• ইন্দিরা ঘটক
সুলতানার স্বপ্ন
• রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন
নিমগ্ন আলোতে তাঁরা কয়েকজন: বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য চার নারী ব্যক্তিত্ব
• মাহরীন ফেরদৌস
ঠাকুরবাড়ির নারীদের সাহিত্যচর্চা
• শান্তা শ্রীমানী
শান্তিনিকেতনে আশ্রমকন্যা
• প্রণতি মুখোপাধ্যায়
লীলা মজুমদার: ঘর-বাইরের কিছু প্রশ্ন
• রুশতী সেন
গৌরী ধর্মপাল
• মৌ দাশগুপ্ত
সুকুমারী ভট্টাচার্যের বীক্ষণে সম্পর্কের সমীকরণ
• অনন্যা মিত্র
মহাশ্বেতার কথাসাহিত্য: এক অনিঃশেষ প্রতিবাদের আখ্যান
• শম্পা চৌধুরী
সেলিনা হোসেনের ছোটোগল্প: কালের যাত্রার ধ্বনি
• শ্রাবণী পাল
‘যা কুড়িয়েছি কিছু ফেলতে পারিনি’: কল্যাণী দত্তের লেখায় জমে ওঠা সময়ের কথা
• শাশ্বতী রায়
বইয়ের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি
• শান্তা ভট্টাচার্য
সই
• কাহিনী ঘোষ
খোঁজ এখন: মানবীচেতনার পরিসর
• বর্ণালী পাইন
রাবণ ও প্রমীলা সংবাদ: প্রান্ত ও প্রান্তের বাইরে মেয়েদের জীবন
• সোমাইয়া আখতার
আর জন্মের ঘর: মধুমিতার মেয়ে-পাঁচালি
• অর্পিতা ভট্টাচার্য
আত্মনিরিখে সম্পাদনা প্রসঙ্গ
• আসমা বীথি
মেয়েদের পত্রিকা, পণ্যের মায়ামোহ এবং পুরুষের কামনা বাসনা
• বর্ণালী পাল
বাংলা কবিতায় নারীবয়ানের ভিন্ন স্রোত
• বল্লরী সেন
শূন্য ও প্রথম দশকের কবিতা-মিথের বিনির্মাণ
• রাকা দাশগুপ্ত
মেয়েদের লেখালেখি
• তৃপ্তি সান্ত্রা
গ্রাহক হোন
হরপ্পার গ্রাহক হতে গেলে দুটি সংখ্যার জন্য মোট আটশো টাকা দিতে হয়। (অতিরিক্ত ডাকমাশুল লাগবে না)
যোগাযোগ করুন ই-মেলে অথবা ফোনে কথা বলুন।
সরাসরি প্রাপ্তিস্থান
• হরপ্পার পরিবেশক পশ্চিমবঙ্গে অক্ষর প্রকাশনী, ১৮এ টেমার লেন, কলকাতা-৯ ও বাংলাদেশে বাতিঘর।
• কলেজস্ট্রিটে পাতিরাম, ধ্যানবিন্দু, দেজ, দে বুকস্টোর, উল্টোডাঙায় সুনীলদার দোকান, রাসবিহারী মোড়ে কল্যাণদার দোকান, রিড বেঙ্গলি বুক স্টোর, শান্তিনিকেতনে রামকৃষ্ণর দোকানের মতো বহু স্টলে হরপ্পা নিয়মিত পাওয়া যায়। এছাড়া অনলাইনে হরপ্পা বিক্রি হয়।
• পত্রিকা পেতে আপনি দপ্তরেও মেল করতে পারেন।
বৈদ্যুতিন পুস্তিকা
করোনার আক্রমণে অন্তরীণ অবস্থায় ১ বৈশাখ ১৪২৭ থেকে ‘হরপ্পা’-র বৈদ্যুতিন পুস্তিকা প্রকাশের সূচনা। এই পুস্তিকা নিজেদের ওয়েবসাইট, সামাজিক মাধ্যম, যেমন ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে পাঠকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। দেখবেন চলুন...