<Transparent Logo
Scroll down

head_bish

বিষ বিষাক্ত বিষময়
৭ অগস্ট, ২০২০

বিষের ব্যবহার বাংলা সাহিত্যে শুরু হয়েছিল বোধহয় মনসামঙ্গল-এ। চাঁদসদাগরের জেদ, লখিন্দরের সাপের কামড়ে মৃত্যু, বেহুলার স্বামীর জীবন ফিরিয়ে আনতে কঠোর সংকল্প—সে-কাহিনির কেন্দ্রে ছিল বিষ। প্রাচীন মনসামঙ্গল-এর কাহিনিতে ব্যবহৃত এই বিষের প্রয়োগ পাওয়া যায় হাল-আমলের গোয়েন্দা-কাহিনিতেও। ১৪২৭ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ-সংক্রান্তিতে মনসাপুজোর শুভলগ্নে প্রকাশিত এই পুস্তিকায় সে-ধারা সার্থকভাবে উপস্থাপিত হল নতুন ও পুরোনো বাংলা রহস্য-গল্পের উদাহরণসহ। ...

কী আছে ভিতরে

আজ শ্রাবণ-সংক্রান্তি—বাংলার নানা জেলায় গ্রামগঞ্জে বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হচ্ছে মনসা পুজো। মনসা সর্পদেবী। অন্যভাবে বললে তিনি বিষের দেবী। গাঁ-ঘরে স্বামীসন্তান নিয়ে ঘরকন্না করতে ব্যস্ত এয়োস্ত্রীরা সর্পমাতাকে তুষ্ট রাখতে পুজো-ব্রত যে করবেন, তা অস্বাভাবিক নয়। শ্রাবণ মাসের এই পুজোর উল্লেখ আছে মনসামঙ্গল কাব্যে, যেমন কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল, প্রথম খণ্ডে বলা হয়েছে:

জ্যৈষ্ঠ অতি পূজা হব দশরা-দিবসে॥
আষাঢ়েতে হব নাগ পঞ্চমীর পূজা।
ঝাঁপান করিব যত ঝাঁপানিয়া ওঝা॥
শ্রাবণ মাসেতে লবে খরা তরা।
খই দধি দিয়া লোক পলিবেক চিরা॥

এর উল্লেখ আছে বিজয় গুপ্তের পদ্মপুরাণ-এ:

চান্দোসদাগর বেটা চম্পকিয়া রাজা।
চম্পক নগরে বেটা মানা করে পূজা॥
এইত শ্রাবণ মাসে মনসা পঞ্চমী।
লুকাইয়া সনকা পূজে তথা গেলাম আমি॥

এমনকি এই মাসে মনসা পুজোর কথা পাওয়া যায় দীনেশচন্দ্র সেন সঙ্কলিত মৈমনসিংহ-গীতিকা-র ‘মলুয়া' পালায় (পৃ ৮৪):

শায়ন মাসেতে লোকে পূজে মনসা।
এই মাসেতে আইব সোয়ামী মনে বড় আশা॥

‘কমলা' পালা-য় (পৃ ১৬১):

কিসের ঢাক কিসের ঢোল কিসের বাদ্য বাজে।
শায়ন্যা সংক্রান্তে রাজা মনসারে পূজে॥

‘দেওয়ান ভাবনা' পালা'-য় (পৃ ১৮৭):

শায়ন মাসেতে দূতি পূজিলা মনসা।
সেইতে না পূরিলগো আমার মনের আশা॥

দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা-র চতুর্থ খণ্ডে, দ্বিতীয় সংখ্যায়, ‘বগুলার বারমাসী'-তে (পৃ ২২৫) উল্লেখ রয়েছে:

শাওন বাওনা মাস আথাল পাথাল পানি।
মনসা পূজিতে কন্যা হইল উৎযোগিনী॥
কান্দিয়া বসাইল ঘট আপনার গিরে।
প্রাণপতি ঘরে আইসে মনসার বরে॥
চাচর চিক্কণ কেশে গিরটি মাঞ্জিল।
নূতন পিটালি দিয়া আলিপনা দিল॥
পঞ্চনাগ আঁকে কন্যা শিরের উপরে।
মনসা দেবীরে আঁকে অতি ভক্তিভরে॥
শির নোয়াইয়া করে শতেক পন্নতি।
“বর দাও মনসাগো ঘরে আইওক পতি॥"

মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের উন্মেষের সময় যে মঙ্গলকাব্যগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রূপে বিবেচিত হয় তার মধ্যে অন্যতম প্রাচীন এবং প্রণিধানযোগ্য এই মনসামঙ্গল কাব্য। লোকমুখে এর প্রচার-প্রসার সেকালে যে হয়েছিল তা এর জনপ্রিয়তা থেকেই স্পষ্ট। পালাগানের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে তা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। কোথাও-কোথাও একাধিক দিনব্যাপী সংগীতময় আনুষ্ঠানিকতায় আয়োজন হয় মনসাব্রতর। লোকসাহিত্য পুথির পাতা থেকে বেরিয়ে এসে সার্থকতা খুঁজে পায় মৌখিক গতিময়তায়। কখনও তা স্থান পায় শিল্পীর কল্পনায় পটচিত্রে ও পটের গানে। পাড়া-ঘরে মেয়ে-বউরা উলু দিয়ে শাঁখ বাজিয়ে গেয়ে ওঠে:

মনসা জগতে গৌরী জয় বিষহরি।
পদ্মফুলে জন্ম মা তোর মনসা কুমারী॥
নাগের হোল খাট-পালঙ্ক নাগের সিংহাসন।
হংসপৃষ্ঠে নাগমাতা মনসার আসন॥
তরজে গরজে বেণী মোজড়ায় দাড়ি।
কাঁধে নিল চাঁদ বেনে হেতালের বাড়ি॥
যদি বেটির ঢ্যামনীরে নাগাল আমি পাই।
মারিব হেতালের বাড়ি কোমর চূড়ায়॥
সেই গান বিষহরি আপনি শুনিল।
ক্রোধভরে চাঁদবেনের ছ'বেটারে খাইল॥

আর এই জনপ্রিয়তার গভীরতা আমরা বর্তমান বিজ্ঞাননির্ভর পৃথিবীতেও অনুভব করি লৌকিক জীবনে লোকদেবী মনসার পুজো-ব্রত-পালুনির ঘনঘটা দেখে। চাঁদসদাগরের জেদ, ছয়-ছয়টি পুত্র-হারানোর শোক, বেহুলার স্বামীর জীবন ফিরিয়ে আনতে কঠোর সংকল্পের সাহিত্য-কাহিনির কেন্দ্রবিন্দুতে আছে বিষধর সাপের দংশনে চাঁদের পুত্র ও বেহুলার স্বামী লখিন্দরের মৃত্যু। বিষক্রিয়ায় মৃত্যু মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দুতে যেমন ছিল তেমনি তার পরিবর্তিত রূপ আজ আমরা দেখতে পাই তুলনামূলক আধুনিক রহস্যকাহিনি বা গোয়েন্দা গল্পেও। বর্তমান পুস্তিকায় লেখক মূলত বাংলা গোয়েন্দা-সাহিত্যে বিষের ব্যবহারটিকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। যে-কোনো গোয়েন্দা-কাহিনির মূলে থাকে রহস্যময় এক বা একাধিক মৃত্যু বা অন্য কোনো গর্হিত অপরাধ। বিষ প্রয়োগ করে খুন করতে যেহেতু বিশেষ কোনো মুনশিয়ানার প্রয়োজন হয় না এবং অপরাধটি নিঃশব্দে সেরে ফেলা যায়, তাই বোধহয় গোয়েন্দা-সাহিত্য স্রষ্টারা রহস্যের জাল বুনতে খুনিকে দিয়ে বিষের ব্যবহার করিয়েছেন। যেমন খ্যাতনামা বিদেশি গোয়েন্দা-কাহিনিকার আগাথা ক্রিস্টির চোদ্দোটি রহস্য-গল্পে এ ধরনের বিষের ব্যবহার করে খুনের ঘটনা আছে। এর প্রভাব বাংলা রহস্য-কাহিনিতেও স্বাভাবিকভাবে পড়েছিল। তবে শুধু গল্পে নয়, বাস্তব জীবনেও ষড়যন্ত্র-হত্যায় বিষের ব্যবহার ঘটত অহঃরহ। সে-উদাহরণ থেকেও কাহিনিকাররা প্রভাবিত হতেন। প্রাথমিকভাবে ধুতরো-কুচিলার বিষের প্রয়োগ দেখা গেলেও পরে মাকড়সার রস থেকে ‘ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়া'য় না-থাকা বিষের প্রয়োগও গোয়েন্দা-সাহিত্যে পাওয়া যায়। নীহাররঞ্জন গুপ্ত থেকে কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায় থেকে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সুখময় মুখোপাধ্যায় থেকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়—সব লেখকই তাঁদের কোনো-না-কোনো রহস্য-গল্পে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু ও গোয়েন্দাদের ধুরন্ধর বুদ্ধি খাটিয়ে খুনিকে ধরার কাহিনি তুলে ধরেছেন। বেশ কিছু কাহিনি জনপ্রিয়তার কারণে চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছে। তবে বিষয়টা এমন নয় যে গোয়েন্দা গল্প ছাড়া সাহিত্যের অন্য কাহিনিতে বিষের ব্যবহারে মৃত্যু হয়নি। অন্য ধারার গল্পেও বিষ-প্রয়োগে মৃত্যুর উদাহরণ আছে আমাদের বাংলা সাহিত্যে। আসুন করোনা-আক্রান্ত এই সংকট সময়ে আমরা যখন ‘ভ্যাকসিন' নামক একটি নিয়ন্ত্রিত বিষের জন্য অপেক্ষা করছি তখন এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নিই বাংলা রহস্য-সাহিত্যে বিষের প্রভাবে মৃত্যুর দাস্তানে।

ডাউনলোড করুন

প্রকাশকাল: ১৭ অগস্ট, ২০২০
তথ্যসংশ্লেষ ও লিখন: অরিন্দম দাশগুপ্ত
প্রচ্ছদ ও শিল্প-নির্দেশনা: সোমনাথ ঘোষ

সম্পাদক: সৈকত মুখার্জি

গ্রাহক হোন
হরপ্পার গ্রাহক হতে গেলে বছরে তিনটি সংখ্যার জন্য মোট পাঁচশো টাকা দিতে হয়। (ডাকমাশুল আলাদা)
যোগাযোগ করুন ই-মেলে অথবা ফোনে কথা বলুন।

সরাসরি প্রাপ্তিস্থান
• হরপ্পার পরিবেশক পশ্চিমবঙ্গে অক্ষর প্রকাশনী, ১৮এ টেমার লেন, কলকাতা-৯ ও বাংলাদেশে বাতিঘর।
• কলেজস্ট্রিটে পাতিরাম, ধ্যানবিন্দু, দেজ, দে বুকস্টোর, উল্টোডাঙায় সুনীলদার দোকান, রাসবিহারী মোড়ে কল্যাণদার দোকান, রিড বেঙ্গলি বুক স্টোর, শান্তিনিকেতনে রামকৃষ্ণর দোকানের মতো বহু স্টলে হরপ্পা নিয়মিত পাওয়া যায়। এছাড়া অনলাইনে হরপ্পা বিক্রি হয়।
• পত্রিকা পেতে আপনি দপ্তরেও মেল করতে পারেন।

মুদ্রিত সংখ্যা
হরপ্পার যাত্রা শুরু ২০১৭-র অক্টোবর মাসে চতুর্মাসিক পত্রিকা হরপ্পা লিখন চিত্রণ-এর প্রকাশলগ্নে। মূলত সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে হরপ্পা আত্মপ্রকাশ করে বাংলার শিল্পসংস্কৃতি আচার অনুষ্ঠান রীতিনীতি পালাপার্বণ প্রভৃতি নানা বিষয়কে দু-মলাটের ভিতর নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরার লক্ষ্যে। দেখবেন চলুন...